বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবন লাগোয়া ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত হতে যাচ্ছে এই কেন্দ্র। রামপালের এই কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রটি খুলনা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার ও মংলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। এমনকি সুন্দরবন থেকেও মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
জ্বালানি সমস্যাই আমাদের প্রধান সমস্যা। সরকার জ্বালানির সংকট নিরসনে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আগে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে একটি প্রশ্নই বারবার উঠে আসছে,আর তা হলো- সুন্দরবনের এত কাছে কেন নির্মিত হবে এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র? আর কি কি পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ?
সরকারি পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ)অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানী করতে হবে। আমাদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সুন্দর বনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে!
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষাতেই স্বীকার করা হয়েছে, এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে-
১) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুড়া, ভাঙা /টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানি সহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নি:সৃত হয়ে নদী-খাল-মাটি সহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে।
২) সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা উঠানো নামানোর সময় কয়লার গুড়া, ভাঙা কয়লা পানিতে/মাটিতে পড়ে- বাতাসে মিশে মাটিতে মিশে ব্যাপক পানি-বায়ু দূষণ ঘটাবে।
৩) চলাচলকারী জাহাজের ঢেউয়ে দুইপাশের তীরের ভূমি ক্ষয় হবে।
৪) কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ ও কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দ দূষণ হবে।
৫) রাতে জাহাজ চলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণী সহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে ইত্যাদি।
সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বন। যেখানে ২৪০০০ প্রজাতির প্রাণীকুলের বসবাস রয়েছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত দিক থেকে সুন্দরবনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সুন্দরবনের বাঁচা মরার উপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৭ টি জেলার বাঁচা মরা। ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালের ৭ ডিসেম্বর জীববৈচিত্রের জন্য সুন্দরবনকে ‘ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ৩০ আগস্ট ১৯৯৯ অপরিকল্পিত কার্যকলাপের কারণে সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে।
এখন প্রশ্ন এটাই যে এত কারণের পরেও কেন সুন্দরবনে নির্মিত হতে যাচ্ছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র? যদিও পরিবেশবিদদের আশংকার জবাবে পিডিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, এ কেন্দ্র পরিবেশের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। তিনি আরো বলেন, এ কেন্দ্র থেকে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ‘অ্যাশ’(ছাই) বের হবে তা ‘ক্যাপচার’ করার জন্য উচ্চ ক্ষমতার সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে। তবু আশংকা মুক্ত হতে পারছেন না কেউই। পরিবেশবিদ গণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে জন্ম হয়েছে নানা প্রশ্নের।
বাগেরহাটের পশুর নদের তীরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে এর বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আচ্ছন্ন করে ফেলবে সুন্দরবন এলাকার নির্মল আকাশ। চিমনি দিয়ে উগরানো ছাই বিস্তীর্ন এলাকার বাতাসে ঘটাবে মারাত্মক দূষণ। কারখানাটির কার্বন, পারদ, সিসা, আর্সেনিকসহ নানা বর্জ্য সরাসরি দূষিত করবে নদীনালার পানি। পরিবেশ বিদগণের একটা বড় অংশ তাই আশংকা করছেন যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে সুন্দরবন পৌঁছে যাবে নিশ্চিত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।